সত্যজিৎ রায়ের অমর সৃষ্ট গোয়েন্দা চরিত্র “প্রফেসর শঙ্কু!” চলুন জেনে নিই প্রিয় গোয়েন্দাকে নিয়ে সমস্ত তথ্য! 🔍
প্রফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের একটি জনপ্রিয় চরিত্র। ১৯৬১ সালে সত্যজিৎ রায় এই চরিত্রটি সৃষ্টি করেন। প্রোফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু প্রফেসর শঙ্কু নামেই সমধিক পরিচিত। তিনি একজন বৈজ্ঞানিক ও আবিষ্কারক। তাঁর বিশেষত্ব হল, মূলত পদার্থবিজ্ঞানী হলেও বিজ্ঞানের সকল শাখায় তাঁর অবাধ গতি; তিনি ৬৯টি ভাষা জানেন, হায়ারোগ্লিফিক পড়তে পারেন, হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়োর লিপি উনিই প্রথম পড়তে পারেন; এবং বিশ্বের সকল দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, ধর্ম, সামাজিক রীতিনীতি ও বিশ্বসাহিত্য বিষয়ে তাঁর সম্যক ধারণা রয়েছে।
সত্যজিৎ রায় প্রফেসর শঙ্কু সিরিজে মোট ৩৮টি সম্পূর্ণ ও ২টি অসম্পূর্ণ গল্প লিখেছেন। এই সিরিজের প্রথম গল্প ব্যোমযাত্রীর ডায়রি ১৯৬১ সালে সন্দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এই গল্পটি হালকা চালে লেখা এবং এটি লেখার সময় লেখক প্রোফেসর শঙ্কু চরিত্রটি নিয়ে সিরিজ করার কথা ভাবেননি।
১৯৬৪ সালে সন্দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত দ্বিতীয় শঙ্কু-কাহিনি প্রফেসর শঙ্কু ও হাড় থেকে যথাযথভাবে শঙ্কু সিরিজের সূচনা হয়। ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত প্রফেসর শঙ্কু শঙ্কু সিরিজের প্রথম গল্পগ্রন্থ। ১৯৬৫ থেকে ১৯৯৫ সালের মধ্যে শঙ্কু সিরিজের মোট আটটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে শঙ্কুসমগ্র গ্রন্থে এই সিরিজের সকল গল্প সংকলিত হয়।
শঙ্কু সিরিজের গল্পগুলি প্রোফেসর শঙ্কুর জবানিতে দিনলিপির আকারে লিখিত। গল্পগুলির পটভূমি ভারত সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। প্রফেসর শঙ্কুর নিবাস তদনীন্তন বিহারের (অধুনা ঝাড়খণ্ড) গিরিডি শহরে। বাড়িতে তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী নিউটন নামে ২৪ বছরের একটি পোষা বিড়াল ও তাঁর চাকর প্রহ্লাদ। বিশ্বের নানান দেশের বিজ্ঞানীরা তাঁর বন্ধু, তাদের মধ্যে বহুবার উল্লিখিত হয়েছে ক্রোল ও সন্ডার্সের নাম। প্রতিবেশী অবিনাশ চন্দ্র মজুমদার (চাটুজ্যে, উল্লেখ করা হয়েছে "প্রোফেসর শঙ্কু ও ভূত" গল্পে) ও হিতাকাঙ্ক্ষী নকুড়বাবু (নকুড় চন্দ্র বিশ্বাস) তাঁর কোনো কোনো অভিযানে সঙ্গী হয়েছেন।
সমগ্র শঙ্কু সিরিজে প্রফেসর শঙ্কুর ৭২টি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কথা জানা যায়। সত্যজিৎ রায় একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, প্রফেসর শঙ্কু চরিত্রটি সৃষ্টির পিছনে প্রধান প্রেরণা ছিল তাঁর পিতা সুকুমার রায়ের গল্প হেসোরাম হুঁশিয়ারের ডায়রি। অন্যমতে, এই চরিত্রে সুকুমার রায়ের 'নিধিরাম পাটকেল' চরিত্রটির ছায়াও বর্তমান।
প্রফেসর শঙ্কুর জন্মতারিখ ১৬ জুন বলে উল্লিখিত হয়েছে। তাঁর পিতা ত্রিপুরেশ্বর শঙ্কু ছিলেন গিরিডির খ্যাতনামা আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক। তিনি গরিব মানুষদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা করতেন। মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে তিনি মারা যান। শঙ্কুকে তিলু বলে ডাকতেন (নকুড়বাবু এই সূত্রে শঙ্কুকে তিলুবাবু বলে সম্বোধন করতেন)। শঙ্কু ছিলেন অবিবাহিত। তাঁর অপর কোনো আত্মীয়ের নাম সিরিজে উল্লিখিত হয়নি। কেবল প্রোফেসর শঙ্কু ও ভূত গল্পে তাঁর অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহ বটুকেশ্বর শঙ্কুর উল্লেখ আছে।
"নকুড়বাবু ও এল ডোরাডো" তে ঠাকুরদা বটুকেশ্বর এর কথা বলা আছে, যিনি শ্রুতিধর ছিলেন (তাঁর অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহের নামও বটুকেশ্বর, "প্রফেসর শঙ্কু ও ভূত" গল্পে পাই)। এছাড়া আর এক খুড়তুতো ভাইয়ের উল্লেখ আছে, "প্রফেসর শঙ্কু ও ভূত" গল্পেই, যিনি বেরিলি থাকেন এবং তার উচ্চতা ছ ফুট দু ইঞ্চি, এর বেশী আর কিছু জানা যায় নি।
ছাত্র হিসেবে শঙ্কু ছিলেন অসাধারণ। জীবনে সর্বদাই প্রথম হতেন। গিরিডির স্কুল থেকে মাত্র ১২ বছর বয়সে ম্যাট্রিক পাস করেন শঙ্কু। এরপর ১৪ বছর বয়সে কলকাতার কলেজ থেকে আইএসসি এবং ১৬ বছর বয়সে ফিজিক্স ও কেমিস্ট্রিতে ডবল অনার্স সহ বিএসসি পাস করেন। মাত্র ২০ বছর বয়সে কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন।
বিজ্ঞানী হিসেবেও শঙ্কুর খ্যাতি বিশ্বজোড়া। সুইডিশ আকাদেমি অফ সায়েন্স তাঁকে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করেছে। ব্রাজিলের রাটানটান ইনস্টিটিউট থেকে পেয়েছেন ডক্টরেট। পাঁচটি মহাদেশের বিজ্ঞানীরা আবিষ্কারক হিসেবে তাঁকে স্থান দিয়েছেন টমাস আলভা এডিসনের পরেই। স্থায়ী নিবাস গিরিডি শহরে হলেও কর্মসূত্রে যেতে হয়েছে কলকাতা সহ ভারতের নানা স্থানে। গেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, জার্মানি, জাপান, স্পেন, মিশর, নরওয়ে, সুইডেন, তিব্বতে; অভিযান চালিয়েছেন সাহারা মরুভূমি, আফ্রিকার বনভূমি, সমুদ্রের তলদেশে, কয়েকটি অজানা দ্বীপে এমনকি মঙ্গলগ্রহেও।
প্রফেসর শঙ্কু তীক্ষ্ণবুদ্ধি, নির্লোভ ও সৎ। কিছুটা আত্মভোলা প্রকৃতির মানুষ। তাঁর চরিত্রে বিশেষভাবে লক্ষণীয় এক ঋষিসুলভ স্থৈর্য ও সংযম। তিনি স্বদেশপ্রেমিক; বেদ, উপনিষদ, আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা গভীর। আবার বিশ্বের অন্যান্য দেশের শিল্প ও সাহিত্যের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল। তিনি জ্যোতিষে বিশ্বাস না করলেও ভূতপ্রেত ও তন্ত্রমন্ত্রে বিশ্বাস করেন।
প্রথম উপস্থিতি: ব্যোমযাত্রীর ডায়রি
শেষ উপস্থিতি: স্বর্ণপর্ণী
স্রষ্টা: সত্যজিৎ রায়
সম্পূর্ণ নাম: প্রফেসর শঙ্কু
বাসস্থান: ধুপগুড়ি, পশ্চিমবঙ্গ
পোষ্য: লাকি (কুকুর)
ভাষা: ৬৯টি ভাষা জানেন
মাতৃভাষা: বাংলা
ডাকনাম: রোদ্দুর
লিঙ্গ: পুরুষ
পেশা: বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারক; প্রথম জীবনে স্কটিশ চার্চ কলেজের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক।
আত্মীয়: আয়ুর্বেদ চিকিৎসক ত্রিপুরেশ্বর শঙ্কু (পিতা); বটুকেশ্বর শঙ্কু (অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহ)
জাতীয়তা: ভারতীয়
প্রফেসর শঙ্কু মোট ৭২টি আবিষ্কারের কথা জানা যায়। এই সব আবিষ্কার ও তাদের নামকরণের ক্ষেত্রে সত্যজিৎ রায়ের ভাষাপ্রীতি ও কৌতুকবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন, শঙ্কু আবিষ্কৃত রোবট বিধুশেখর সাধু ও চলিত বাংলায় কথা বলতে পারে; আবার তৃষ্ণানাশক বড়ির নাম ‘তৃষ্ণাশক বড়ি’।
শঙ্কুর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার হল:
বটিকা ইন্ডিকা, এয়ারকন্ডিশানিং পিল, লিঙ্গুয়াগ্রাফ, লুমিনিম্যাক্স, সমুনলিন, রিমেম্ব্রেন, মিরাকিউরল, রোবু ও বিধুশেখর নামক দুটি রোবট, অ্যানাইহিলিন পিস্তল, শ্যাঙ্কোপ্লেন, ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন-শঙ্কু ফরমুলা ইত্যাদি।
❏ পরবর্তীতে কোন গোয়েন্দা চরিত্রের তথ্য জানতে চান কমেন্ট করুন। ভাল লাগলে শেয়ার করুন। ❐
#কালেক্টেড